কুরবানীর ফজিলত ও মাসাঈল
- আপডেট সময় : ০১:২৬:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ জুন ২০২৩ ২৭৭ বার পঠিত
মাওলানা শহিদুর রহমান:
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুহাম্মদ সা: এরশাদ করেছেন হযরত দাউদ আ: আল্লাহর নিকট প্রশ্ন করেছিলেন ইয়া আল্লাহ ! শেষ নবীর উম্মতেরা যারা কুরবানী করবে তাদের তুমি কি পরিমান পুণ্যের অধিকারী করবে? আল্লাহ বলেন, কুরবানীর জন্তুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে তারা দশটি পূণ্য পাবে, দশটি অপরাধ ক্ষমা হবে এবং মর্যাদার দশটি স্তর উন্নত হবে। প্রশ্ন করলেন কুরবানীর জন্তর পেট ফাঁড়ার সময় কি পরিমাণ পূণ্য লাভ হয়? আল্লাহ তাআলা বললেন, তার প্রতিদান হলো কুরবানী দাতা ক্বিয়ামতের দিন যখন কবর থেকে উঠবে তখন সে ক্ষুদা ও তৃষ্ণা উপলব্ধি করবে না। সে কিয়ামতের ভয়-ভাবনা থেকে মুক্ত থাকবে। হে দাউদ ! যে ব্যক্তি কুরবানী করে তার কুরবানীর প্রত্যেকটি গোস্ত টুকরার পরিবর্তে বেহেশতে উট পরিমান একটি করে জানোয়ার এবং প্রত্যেকটি গোস্তের টুকরার পরিবর্তে বেহেশতী ঘোড়া দান করা হবে। কুরবানীর জন্তুর দেহে যত পশম হবে তাকে বেহেশতে ততটি মহল দান করা হবে ও প্রত্যেকটি পশমের পরিবর্তে তার খেদমতের জন্য হুর দেয়া হবে।
হে দাউদ! তুমি কি অবগত নও যে কুরবানীর জন্তু কুরবানী দাতাতের যানবাহন। কুরবানী বিপদ ও পাপকে দূর করে দেয়। অতএব তুমি লোকদিগকে কুরবানী করতে আদেশ করো। অপর এক বর্ণনায় হযরত যায়দ ইবনে আরকাম রা: বর্ণনা করেন, একদিন রাসুল সা: এর সাহাবীগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন হে আল্লাহর রাসুল! এই কুরবানী কি? জবাবে হুযুর সা: বললেন এ তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আ: এর সুন্নত বা রীতি। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো এতে আমাদের জন্য কি সওয়াব রয়েছে? জবাবে নবীজি সা: বললেন কুরবানীর জন্তু প্রতিটি পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকি রয়েছে। তারা আবারও জিজ্ঞেস করলেন পশমওয়ালা পশুদের ব্যাপারে কি হবে? হুযুর সা: বললেন, পশম ওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি একটি নেকী রয়েছে।
কুরবানীর লক্ষ্য -উদ্দেশ্য ও শিক্ষা: কুরবানীর উদ্দেশ্য হচ্ছে-তাক্বওয়া ও আল্লাহর রিজামন্দী অর্জন করা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- এ ছাড়াও কুরবানীর লক্ষ্য হলো নিজের মনের খাহিশাত ও নফসের চাহিদাকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করে নিজেকে দ্বীনের জন্য নিবেদন করা এবং প্রতিটি কাজে ইখলাস অবলম্বন তথা তা একমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য করা। এ ক্ষেত্রে গোশত খাওয়া উদ্দেশ্য নয় বরং পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করাই উদ্দেশ্য। আর গোশত হচ্ছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য উপহার স্বরূপ। কুরবানী আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, ইবরাহীমি কুরবানীর স্মৃতি গাঁথা ইতিহাস থেকে খলীলি ইশকের দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আহকামে ইলাহীর সামনে নিজের খাহেশাত বা কামনা বাসনাকে কুরবানী করার শিক্ষা দেয় কুরবানী। নিজেকে ইসলামের তরে সপে দেয়ার শিক্ষা দেয়। প্রকৃতপক্ষে কুরবানী হচ্ছে ত্যাগের এক সমুজ্জল দৃষ্টান্ত। বলাবাহুল্য, পশু কুরবানী তো একটি প্রতিকী আমল। কুরবানীর প্রাক্কালে সর্বাগ্রে নফ্সানী খাহেশাত, প্রবৃত্তি, লোভ-লালসা ও দুনিয়ামুখির গলায় ছুরি চালানোর শিক্ষা দেয়। নিজের মনের খেয়াল-খুশিতে নয়, বরং আল্লাহ ও রাসুলের সা: নির্দেশ মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথে চলার সংকল্প গ্রহণ করার শিক্ষা দেয় যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার আশঙ্কায় সর্ব প্রকার অনৈসলামিক বা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়।
কুরবানীর সময়: ১০ জিলহজ্ব হইতে ১২ ই জিলহজ্বের সন্ধ্যা পর্যন্ত এই তিনদিন কুরবানী করার সময়। এই তিনদিনের মধ্যে যেই দিন ইচ্ছা সেইদিন কুরবানী করা যাবে। তবে প্রথম দিন সর্বাপেক্ষা উত্তম। তার পর দ্বিতীয় দিন, অত:পর তৃতীয় দিন। তবে রাত্রে কুরবানী করা মাকরূপ কিন্তু ১২ জিলহজ্ব দিনের বেলায় কোন কারণে কুরবানী করতে না পারলে পরবর্তী রাত্রে কুরবানী করা জায়েয হবে।
যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব: জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে পরিবার-পরিজনের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, আসবাবপত্র এবং কর্জের পরিমাণ বাদ দিবার পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মুল্যের সমান নগদ টাকা, ব্যবসা পণ্য , গহনা, অতিরিক্ত পোশাক বা শাড়ী ফ্রিজ, টেলিভিশন প্রভৃতি থাকে সে মালেকে নেছাব হবে। এবং তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। স্বামী-স্ত্রী অথবা যৌথ পরিবারে প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর যাদের নিকট পৃথক পৃথকভাবে নেছাব পরিমান মাল থাকে। তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী)
যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়: যে ব্যক্তি মালেকে নেছাব নয় তবুও তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। পাগল, নাবালেগ সন্তান যদি মালদার হয়, তবুও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
কুরবানীর জন্তু সমূহ: ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট এ ছয় প্রকার গৃহপালিত জন্তু দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
গর্ভবর্তী পশুর কুরবানী: গর্ভবর্তী পশু কুরবানী করা জায়েয হবে জেনে শুনে এমনটা করা ঠিক নয়। গর্ভবর্তী বলে জানা ছিলো না , জবেহ করার পর পেটে জীবিত বাচ্ছা পাওয়া গেলে ঐ বাচ্ছাও জবেহ করে নিতে হবে। এর গোশত খাওয়া জায়েয আছে। যবেহ না করে সদকা করে দেয়াও জায়েয। মৃত বাচ্চা পাওয়া গেলে এটির গোশত খাওয়া জায়েয হবে না। (শামী পৃষ্টা-২২৭)
কুরবানীর জন্তুর বয়স: ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এ তিন প্রকার জন্তুর ক্ষেত্রে পূর্ণ একবছর বয়স্ক হওয়া জরুরী। কিন্তু যদি ছ মাসের দুম্বা ভেড়া এরূপ মোটাতাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের মত লাগে অর্থাৎ এক বছরের দুম্বা বা ভেড়ার মধ্যে ছেড়ে দিলে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না, তাহলে এরূপ ছ মাসের দুম্বা ও ভেড়া দ্বারা কুরবানী করা জায়েয অন্যথায় ন। ছাগল যতই মোটাতাজা হোক না কেন তার এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরী। একদিন কম হলেও কুরবানী দুরুস্ত হবে না। (শামী ৫ম খন্ড, পৃ:২০৫)
গরু ও মহিষ দুই বছর পূর্ণ বয়স্ক হওয়া জরুরী। একদিন কম হলেও কুরবানী জায়েয হবে না। (মাহমুদিয়া ৫ম খন্ড)
উট পাঁচ বছর পূর্ণ বয়স্ক হওয়া জরুরী। একদিন কম হলেও কুরবানী জায়েয হবে না। জন্তু বিক্রেতা যদি জন্তুর পূর্ণ বয়সের কথা বলে, আর দেখতে এটা সত্য বলে মনে হয়, তাহলে তার কথার উপর নির্ভর করা জায়েয । (শামী ৫ম খন্ড)
যে জন্তু কুরবানী করা দুরস্ত নয়: কুরবানীর জন্তুর নিচের যে কোন একটি দোষ বা ত্রুটি থাকলে উক্ত জন্তু কুরবানী করা দুরস্ত হবে না।
১.যে জন্তুর দুটি চক্ষই অন্ধ বা একটি চক্ষু পূর্ণ অন্ধ বা একটি চক্ষুর তিনভাগের একভাগ বা তার বেশী দৃষ্টি শক্তি নষ্ট।
২. যে জন্তুর কান এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশী কেটে গেছে।
৩. যে জন্তুর লেজ এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশী কেটে গেছে।
৪. যে জন্তুর শিং একেবারেই মুল থেকে ভেঙ্গে গেছে। তবে শিং এর খোলটা উঠে গেছে কিন্তু তার মূল ঠিক আছে তার কুরবানী জায়েয।
৫. যে জন্তুর খোড়া যার একটি ও দাঁত নেই। জন্তুটি এতই দুর্বল যে কুরবানীর স্থান পর্যন্ত যেতে সক্ষম নয়, সে জন্তু কুরবানীর জন্য দুরস্ত নয়।
৬. ঐদিন কোনো গাভীর কোনো গাভীর দুধের এক বাঁট কেটে যায় বা পড়ে যায় তাহলে তার কুরবানী জায়েয হবে না।
৭. যে জন্তুর পাগল হয়ে ঘুড়ে বেড়ায়, খানাপিনা ছেড়ে দেয়, অন্যান্য জন্তুর সঙ্গে থাকেনা তার কুরবানী নাজায়েয। কোন জন্তুর জিহ্বা কেটে যাওয়ায় খাদ্য খেতে অসুবিধা হয় তার কুরবানী জায়েয।
কুরবানীর জন্তুর মধ্যে অংশ: ছাগল, ভেড়া, দুম্বা- যে কোনো একটি একজনের জন্য কুরবানী করা দুরস্ত। গরু, মহিষ, উট – যে কোনো একটি একজন হতে সাত জনের জন্য কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
শরীকানায় কুরবানী: শরীকানায় কুরবানী দুরস্ত আছে হওয়ার কতগুলো শর্ত আছে:- ১. প্রত্যেক শরীকের টাকার অংশ সমান হতে হবে এবং হালাল উপার্জিত অর্থ হতে হবে। ২. সকল শরীকেরই নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে, অর্থাৎ কুরবানীর নিয়ত থাকতে হবে। ৩. শরীকের কোন একজন যদি মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে শরীক হয়, তাহলে কারো কুরবানীই শুদ্ধ হবে না। ৪. কোনো শরীকের অংশ যাতে কম বা বেশী না হয়। ৫. গরু, মহিষ, উট এর কুরবানীর সাথে আক্বীক্বার অংশ দেয়া জায়েয আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোনো শরীকের অনুপস্থিতিতে বা বিনা অনুমতিতে কুরবানী করলে কিংবা তার গোশতের অংশ সাব্যস্ত করলে কুরবানী বৈধ হবে না। পশু খরিদের সময় সাতজন ভাগী হয়ে খরিদ করলে তা জায়েয আছে। একা খরিদ করার সময় পরে অন্যকে শরীক করবে বলে নিয়ত করলে তবে তাও দুরস্ত আছে।