মিহি সুতোর কেরামতি বাহা ফরিদ নিশাপুরি
- আপডেট সময় : ০৯:১৯:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ ১৬১ বার পঠিত
আব্বাসি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা ছিল বিশাল, সেই রক্তখোকো আবু মুসলিম খোরাসানির শাসনামলের ঘটনা। নিশাপুরের সিরাওন্দ নামক জনপদ থেকে বেরিয়ে আসে বাহা ফরিদ নিশাপুরি নামের এক ভয়ংকর প্রতারক। লোকটি বেরিয়েই ইসলামের শ্বাশ্বত আকিদা খতমে নবওয়াতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দাবি করে বসে, তার ওপর নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নাজিল হয়! কিন্তু নবুওয়াতের দাবি করার পরপরই কিছুদিনের মধ্যে কোথায় যেন হাওয়া যায়। মানুষ প্রতিবাদী হওয় ভূমিকা রাখার আগেই সে আত্মগোপনে চলে যায়, ফলে মানুষও তার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
আসলে সে আত্মগোপনে যায় নি; বরং দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল চীনে। অনেক দিন পর চীন থেকে বিপুল পরিমাণ উপহারসামগ্রী নিয়ে ফিরে আসে দেশে। উপহারসামগ্রীর মধ্যে ছিল সবুজ মিহি সুতার দৃষ্টিদন্দন একটি জামা। জামার সুতা এতই মিহি ছিল যে, পুরো জামাটি হাতের মুঠিতে আটকে নেওয়া যেত। যেহেতু সে কালের মানুষ সুতা এত মিহি হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারছিল না, তাই প্রতারক বাহা ফরিদ পোশাকটিকে তার মুজিজা আখ্যা দেয়।
বাহা ফরিদ চীন থেকে গোপনে দেশে ফিরে আসে এবং লোকচক্ষু এড়াতে রাতের আঁধারে জনপদে প্রবেশ করে। তবে বাড়িতে প্রবেশ না করে সোজা পাশে থাকা অগ্নিপুজারিদের মন্দিরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে মন্দিরের একেবারে শীর্ষদেশে বসে থাকে। সকালে পুজারিদের আনাগোনা শুরু হলে সে খুব ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে মন্দিরের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে থাকে। মানুষ তাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তারা ভেবে পাচ্ছি না, সুদীর্ঘ সাত বছর নিখোঁজ থাকা লোকটি শেষপর্যন্ত কিভাবে আকাশ থেকে অবতরণ করছে!
মানুষকে হতবাক দেখতে পেয়ে প্রথমেই সে তাদের দিকে প্রতারণার একটি গুলি ছুড়ে মারে। ভাবগম্ভীর্য বজায় রেখেই বলে, ‘আপনারা নিশ্চয় আমাকে দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। মূলত আল্লাহই আমাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে আমাকে অবর্ণনীয় সুখের জান্নাতে রেখে তাঁর অনেক রহস্য উম্মোচন করে দেখিয়েছেন! দেখিয়েছেন জান্নাতের অপরিমেয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি জাহান্নামের ভয়াবহতাও! এরপর আমাকে নবুওয়াতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে পাঠিয়েছেন এই ধুলোর ধরায়! নবুওয়াতের প্রমাণস্বরূপ দান করেছেন, আমার গায়ে থাকা মিহি এ জামাটি! এই মুহুর্তে আমি আসমান থেকে অবতরণ করছি!
নির্বোধ লোকদের কান্ডকারখানার কথা বলে লাভ নেই। সে কথাগুলো বলে শেষ করতে না করতেই ওই সময় মন্দিরের পাশে থাকা এক বোকা কৃষক চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমি নিজে তাকে আসমান থেকে অবতরণ করতে দেখেছি!’ মন্দিরের পূজারিদের অনেকেই তখন কৃষকের কথায় সায় দেয়। এই সুযোগে বাহা ফরিদ তাদের দিকে আরেকটি তির ছুড়ে মারে। হতবাক জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আমার রবের পক্ষে এগুলো করে দেখানো নিতান্তই সহজ কাজ। তোমরা তো আমার গায়েই তাঁর নিদর্শনের ঝলক দেখতে পাচ্ছ। আমাকে তিনি যে পোশাক পরিয়ে সম্মানিত করেছেন, কাছে এসে দেখো-বলো, পৃথিবীর কোনো তাঁতির পক্ষে কি এত মিহি সুতার পোশাক বুনন সম্ভব?
মোটকথা, আকাশ থেকে অবতরণ, আর মিহি সুতার জামার ভাওতা দেখিয়ে সে বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রতারিত করে ঈমানহারা করতে থাকে।
বাহা ফরিদ দীর্ঘদিন তার মিথ্যা নবুওয়াতের প্রচারণা চালিয়ে এক নতুন ধর্মের জন্ম দেয়। সে ইসলাম ও অগ্নিপূজারিদের ধর্মের মাঝামাঝি তৈরি করে নতুন এক ধর্ম। এরপর মানুষকে তার ধর্মের দিকে টেনে নিতে থাকে। ফলে অনেক অগ্নিপূজারি ও মুসলমান প্রতারিত হয়ে দিন দিন তার দল বড় করতে থাকে।
বেশ কয়েক বছর বাহা নির্বিঘ্নে তার তৎপরতা চালিয়ে যায়। জনগণ তখন অসহায়ভাবে তার প্রতারণা দেখে যেতে বাধ্য ছিল। তাদের করার মতো কিছু ছিল না। কারণ, ততদিনে তার দল অনেকটা ভারী হয়ে উঠেছিল। তার শক্তির মোকাবিলায় তারা ছিল সম্পূর্ণ অসহায়। একপর্যায়ে কোনো এক প্রশাসনিক কাজে আবু মুসলিম খোরাসানি নিশাপুর এলে মুসলিম ও অগ্নিপূজারিদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁকে জানায়, ‘বাহা ফরিদ নামের এক প্রতারক এখানে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের বিপরীতে নতুন এক ধর্ম বানিয়ে ভিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। দিন দিন তার জনবল যে হারে বাড়ছে, এ অবস্থ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সে খিলাফতের জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অতএব, আমরা মনে করি, সময় থাকতেই তাকে পাকড়াও করা দরকার। আবু মুসলিম তাদের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কমান্ডার শুবাকে নির্দেশ দেন ‘ ওই প্রতারককে ধরে আমার কাছে নিয়ে এসো। এদিকে আবু মুসলিমের নিশাপুর আগমনের সংবাদ পেয়ে আগে থেকেই সে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। এরপর যখন তার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ শুনতে পায়, তখনই দ্রুত নিশাপুর ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু কমান্ডার শুবা তাকে ধাওয়া অব্যাহত রেখে বাদগিস অঞ্চলে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। এরপর জীবন্ত গ্রেপ্তার করে আবু মুসলিমের কাছে নিয়ে আসেন। আবু মুসলিম তাকে সামনে দেখতে পেয়েই কোনো কথা না বলে তার রক্তপিয়াসি বর্শা আমূল বাহা ফরিদের বুকে বিদ্ধ করে মুহুর্তেই তার নবুওয়াতের ভেলকিবাজি চিরতরে মিটিয়ে দেন।
বাহা ফরিদকে হত্যার পরপর আবু মুসলিম খোরাসানি তাঁর সেনাদলকে ওই প্রতারকের অনুসারীদেরও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা প্রতিনিধিদলকে আবু মুসলিমের কাছে যেতে দেখে তাদের ভবিষ্যৎ অনুমান করে পালিয়ে যায়। ফলে খুব অল্পসংখ্যকই সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। যারা জীবিত ছিল, তারা বিশ্বাস পোষণ করতে আল্লাহ নাকি তাদের নবি বাহা ফরিদকে পুনরায় আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন; সে আবারও উপযুক্ত সময়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে তার শুক্রদের থেকে প্রতিশোধ নেবে।