অন্যায়পুর শহরের ঘটনা
- আপডেট সময় : ০৯:৩৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৩ ১৩০ বার পঠিত
‘অন’ শব্দটি না অর্থবোধক শব্দ, ‘ন্যায়’ অর্থ ইনসাফ, পুর অর্থ শহর। সব মিলে অর্থ হলো বেইনসাফী বা জুলুমের শহর।
এক গুরু তার এক শিষ্য নিয়ে ঐ শহরে গেল। ওখানে গিয়ে দেখল, সব কিছু ষোল টাকা সের বিক্রি হয়। চাল, ডাল, আটা, তৈল, ঘি, সব কিছু একই দাম ষোল টাকা সের। গুরুজী শিষ্যকে বলল, চল এখান থেকে এদেশ আমাদের বসবাসযোগ্য নয়। কেননা এখানে ভাল মন্দ সবকিছু একই দামে বিক্রি হয়। শিষ্য বলল, আমি এখানেই থেকে যাব। বেশি করে ঘি খাব। স্বাস্থ্য ভাল হবে। গুরুজী যত রকমেই বুঝালেন সে কিছুতেই এ শহর ছেড়ে যেতে রাজী হলো না। দীর্ঘদিন এ শহরে থেকে ভাল ভাল জিনিস খেয়ে খুব মোটা তাজা হয়ে গেল।
ঘটনাক্রমে একদিন গুরু ও শিষ্য উভয়েই শাহী দরবারে উপস্থিত হলো। দরবারে এক মোকদ্দমা চলছিল, দুই চুর এক বাড়ীতে চুরি করার জন্য সিঁদ কেটে একজন ঘরে ঢুকছিল আর অন্যজন পাহারায় দাঁড়িয়েছিল। তখন দেয়াল ভেঙ্গে চাপা পড়ে একজন চুর মারা গেল। অপরজন আদালতে এই মর্মে বাড়ীওয়ালার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করেছিল যে, সে এত দুর্বল দেয়াল বানিয়েছে যে, সাধারণ সিঁদে ভেঙ্গে দিয়ে আমার সাথী মারা গেছে। হাকীম সাহেব বাড়ীওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, হুযুর ! এতে আমার কি দোষ? রাজমিস্ত্রি দেয়াল বানিয়েছে, দোষ হলে তার হবে। রাজমিস্ত্রিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলে রাজমিস্ত্রি বলল, আমার দোষ হবে কেন? লেবার হিসাব ভুল করে কম সিমেন্ট দিয়ে মসলা বানিয়েছে, দোষ হলে তার দোষ হবে। লেবারকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলল, হুযুর ! পানি ঢালার যে লেবার ছিল সে পানি বেশি ঢেলে দিয়েছে তাই মসলা খারাপ হয়েছে দোষ হলে তার হবে।
পানিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করা হলে পানিওয়ালা বলল, এতে আমার কোন দোষ নেই, রাজার বাড়ীর হাতীটা এদিক ছুটে আসছিল অমনি ছুটে পালাতে গিয়ে হাত থেকে মসলার উপর বালতি পড়ে যায়,তাই মসলা পাতলা হয়েছে। মাহুতকে জিজ্ঞাসা করা হলে হাতী কেন ছুটে আসল-সে বলল, ঝুমুর পরে এক মহিলা যাচ্ছিল তার ঝুমুরের আওয়াজে হাতী এমন পাগলা হয়ে ছুটেছিল। মহিলাকে উপস্থিত করা হলো। সে বলল, আমার কি দোষ স্বর্ণকারই তো বাজনা দিয়ে ঝুমুর বানিয়েছিল। স্বর্ণকারকে এর কারণ জিজ্ঞাস করলে সে কোন উত্তর দিতে পারল না।
অবশেষে স্বর্ণকারের ফাঁসীর হুকুম হয়ে গেল। তাকে ফাঁসী কাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হলো কিন্তু সে অত্যন্ত দূর্বল ও হালকা গড়নের হওয়ায় ফাঁসীর কড়া তার গলায় বাঁধল না। জল্লাদ খবর দিল এই ফাঁসী কড়ায় এমন তালপাতার সিপাহীকে ফাঁসী দেয়া যাবে না। এর জন্য আরও মোটা তাজা লোক চাই। বস হুকুম হয়ে গেল যাকে মোটা পাওয়া যায় তাকে ফাঁসী দিতে হবে। কেননা, হাকিম নড়লেও তার হুকুম নড়বে না। তালাশ করে গুরুজীর শিষ্যের মত মোটা আর কাউকে পাওয়া গেল না। ধরে নিয়ে আসা হলো তাকে ফাঁসী দেয়ার জন্য। তখন সে গুরুজীর কাছে বলল, উস্তাদ এখন কি করব? গুরুজী বললেন, আগেই তো বলেছিলাম তেল আর ঘি এক দাম এ দেশে থেকে না; তুমি মানলে না, এখন ফল ভোগ কর। সে বলল, হুযুর! কোনরকম প্রাণে বাঁচান। আমি তো আপনারই সন্তান! গুরু ভেবে চিন্তে শিষ্যকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে বের করল।
তারা দুজন পরস্পর সলাপরামর্শক্রমে ঝগড়া বাধিয়ে দিল। গুরু বলে আমি ফাঁসীতে ঝুলব, শিষ্য বলে অসম্ভব কথা! এ সুযোগ আমি কিছুতেই হাতছাড়া হতে দিব না। জল্লাদ! তাড়াতাড়ি আমাকে ফাঁসীতে ঝুলাও। তাদের দুজনের ঝগড়া এতই চরমে উঠল যে, বাদশাহর নিকট খবর পৌছে গেল। বাদশাহ গুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি তোমার ফাঁসী নেওয়ার জন্য ঝগড়া করছ? এমন আশ্চর্য কাণ্ড আর দেখিনি। গুরু বলল, হুযুর! এটা এমন এক মুহুর্ত যে কেউ এসময় ফাঁসী নিবে সে ব্যক্তি সোজা স্বর্গে চলে যাবে। এমন সুযোগ আর ফিরে আসবে না। রাজা বলল, তাহলে তো এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। আমাকে ফাঁসী দিয়ে দাও্ এ সুবর্ণ সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে। সুতরাং ঐ কুলাঙ্গার রাজাকে ফাঁসীতে ঝুলানো হলো। আর এমন হতভাগা রাজার ফাঁসী হওয়াটাই ছিল বাঞ্ছনীয়।
এ ছিল অন্যায়পুরের ঘটনা। অনেক মুসলমান আল্লাহ তাআলারে হুকুমতকেও এমনই মনে করে যে, এখানে কোন নিয়ম কানুন রীতি-নীতি কিছুই নেই যার যা মন চায় তাই করে বেড়াবে আর ইসলামের দোহাই দিয়ে পার হযে যাবে, এটা অসম্ভব।