ঢাকা ০৪:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo সিলেটের বিশ্বনাথে ব্যারিস্টার নাজির ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে শিশুদের ফ্রি খৎনা প্রদান Logo সিলেটের বিশ্বনাথে ফাতেমা খাতুন আদর্শ মহিলা মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন Logo সিলেটের বিশ্বনাথে বৃদ্ধা ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলার ঘর দখলের অভিযোগ :প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন Logo জামিয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথ মাদরাসার ৬৬ তম বার্ষিক ইসলামী মহাসম্মেলন ২৮ ডিসেম্বর Logo সিলেটের বিশ্বনাথে আল মাদরাসাতুল হানাফিয়ায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে সংবর্ধনা Logo সিলেটের বিশ্বনাথে হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের ২৯তম হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন Logo সিলেটের বিশ্বনাথে আল মাদরাসাতুল হানাফিয়ায় দুই শিক্ষানুরাগীকে সংবর্ধনা Logo বিশ্বনাথে নব নিযুক্ত শিক্ষা অফিসার নাস্তিক মাহমুদুল হক অপসারণ ও অবাঞ্ছিত ঘোষনা করে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্টিত Logo ওলামা মাশায়েখ বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইসলামী মহাসম্মেলন থেকে ৯ দফা ঘোষণা Logo তাবলিগের রাহবার আলেমরা, অন্য কেউ নয়

মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই

ইসলামিক মিডিয়া ২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ১১:২৭:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জানুয়ারী ২০২৩ ১১৫ বার পঠিত

ইতিহাস পড়লে অনুমান করা যায়, যুগে যুগে ঘরের শক্রুরা ইসলামের যে ক্ষতি করেছে, প্রকাশ্য শক্ররা তার এক দশমাংশও করতে পারেনি। ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতিসত্তার ওপর বড় বড় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এর মূলে কিন্তু গাদ্দারদেরই ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আপনারা জানেনন, একটি বাগানকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে তুলতে যেমন বাগানে পানি সেচ দিতে হয়, সার ছিটাতে হয়, তেমনি বাগানকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকেও নিরাপদ রাখতে হয়। জাতির গাদ্দাররা এমন বিষাক্ত সাপের মতো, যারা প্রথমে জাতির গা থেকে রক্ত শুষে নেয়, অবশেষে দংশন করে একেবারে মেরে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধর হলো।
মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই
‘মাটি ওড়াবেন না’ রাগে চোখে-মুখ লাল করে বলছিল লোকটি।
প্রিয়নবি সা: এর বাহন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে তখন তার সাথিদের নিয়ে রাস্তার পাশে বসা ছিল। নবিজির ঘোড়ার খুরের আঘাতে ওড়া ধুলোবালি লোকটি ও তার সাথিদের গায়ে গিয়ে লাগলে এভাবে খেপে ওঠে কথাগুলো বলছিল লোকটি; কিন্তু সে তো চিরকালের হতভাগা। সে কি জানত এগুলো কার ঘোড়ার খুরের ধুলো? কী সুমহান মর্যাদা ওই মহামানবের? তাঁর বাহনের ওড়ানো ধুলোর মর্যাদা তো মেশক ও আম্বরের চেয়ে বহুগুণ বেশি। নবিজির সঙ্গে তখন কয়েকজন সাহাবিও ছিলেন। তারা লোকটির এই অশিষ্ট আচরণের জবাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেন। এক সাহাবি তো বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম, নবিজির গাধার গায়ের দুর্গন্ধও তোর গায়ের দুর্গন্ধ থেকে হাজারগুন উত্তম!,
নবিজির সঙ্গে অভদ্র আচরণকারী এই লোকটির নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনু উবাই। সে ছিল মুলত মদিনার ইয়াহুদিদের নেতা। আনসারদের সঙ্গেও তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আনসারদের বড় দুই গোত্র তথা আউস খাজরাজে সে ছিল সমান গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগে আউস ও খাজরাজিরা ছিল একে অপরের প্রাণের শক্রু। বছরের পর বছর পরস্পর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ছিল। একপর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে যায় যে, আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে ইয়াসরিবের (মদিনার) বাদশাহ বানিয়ে নেব, যাতে এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি; ভবিষ্যতে যাতে আমাদের মধ্যে আর লড়াই না বাধে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার মাথায় বাদশাহির মুকুট পরানোর আগেই হজমৌসুম চলে আসে। ফলে মদিনার অনেক মানুষ হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যায়। সেখানে প্রিয়নবি সা: এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। নবিজি সা: তাঁদের ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁরা ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন। হজ শেষে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে স্ব স্ব গ্রোত্র ও মহল্লায় ইসলামের বাণীর প্রচার শুরু করেন। ফলে মদিনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে বাদশাহ বানানোর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কারণ, মদিনাবাসী তো নবিজির মতো দীন-দুনিয়ার অনুপম বাদশাহ পেয়ে গেছে! ফলে আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের মতো কাউকে আর তাদের নেতা মানার প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে ইবুন উবাই- যে এতদিন ধরে মদিনার বাদশাহ হওয়ার রঙিন স্বপ্নজাল বুনে আসছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে অবস্থার মোড় পালটে যেতে দেখে মনে মনে হিংসার আগুনে জ্বলে ভোনা কাবাব হয়ে যাচ্ছিল। সে আনসারদের ইসলামগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এর মধ্যে কিছুদিন পর প্রিয়নবির নির্দেশে একদল সাহাবি মদিনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে আসেন। এরপর তো খোদ নবিজিও আবু বকর রা. কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তখন মদিনার প্রতিটি ঘরে যেন আনন্দের জোয়ার বইছিল। তবে তাঁদের এই আনন্দ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের গায়ে যেন কাঁটা হয়ে বাধছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে তার ক্ষোভ হজম করছিল। কিছুদিন বিভিন্ন বৈঠকে মুসলিমদের নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বলতে থাকে। তবে মানুষ তার এসব কথাকে পাগলের প্রলাপ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে সে নিবিজির নামে বিভিন্ন অপবাদ রটাতে শুরু করে। কিন্তু এবারও হালে পানি না পেয়ে ভাবতে থাকে-নাহ, এভাবে কাজ হবে না; অন্য পথে এগোতে হবে। তখন সে তার শয়তানি মস্তিস্কতাড়িত হয়ে নতুন এক ফন্দি আঁটে।
ইয়াহুদি ধর্মবিশ্বাস ধারণকারী ইবুন উবাই ছিল বেজায় ধূর্ত ও সাংঘাতিক বাকপটু। সে ছিল ধড়িবাজদের উস্তাদ। সে তার কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গকে লক্ষ করে বলে, ‘এভাবে কাজ হবে না। আমাদের বাহ্যত মুহাম্মাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে এবং ভেতরে থেকেই তাদের ধর্মের শিকড় কেটে ফেলতে হবে। আমরা মুসলিমদের অভ্যন্তর থেকে তাদের বিভিন্ন রহস্য কাফিরদের কাছে পাচার করব। তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করব। আমাদের এ কাজটি প্রজন্মান্তর চলতে থাকবে। ,
পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করার পরই ইবুন উবাই তার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে দেয়। তখন তার সঙ্গে কয়েক শ ইয়াহুদিও বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করে। তবে এরা সত্যিকার মুসলমান ছিল না। প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল পাক্কা কাফির। এরা বিভিন্ন সময় মুসলিমদের ভীষণ ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। কুরআন, হাদিস এবং শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের লোকদের ‘মুনাফিক’ বলা হয়। পবিত্র কুরআন মুনাফিকদের পরিণাম প্রসঙ্গে বলেছেন ওরা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম ও সর্বনি¤œ জায়গার অধিবাসী।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুনাফিকদের গুরু। সে প্রথমে উহুদযুদ্ধের সময় মুসলিমদের প্রতি বিষাক্ত ছোবল হানে। উহুদযুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১ হাজার। এর মধ্যে ৩০০ ছিল ইবনু উবাইয়ের সাথি। যুদ্ধে সে তার সাথিদের নিয়ে মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে বেরোলেও কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ এই বলে তার ৩০০ সাথিকে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। ‘আমার পরামর্শ ছিল আমরা মদিনায় থেকে লড়াই করব। যেহেতু আমার পরামর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি, তাই আমি আপনাদের সঙ্গ দিতে পারি না। এ ছাড়া সে মুসলিমদের মধ্যে তখন এই ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায় যে, ‘এটা মূলত কোনো যুদ্ধ নয়; বরং আত্মহত্যার অভিযান। এভাবে সে ও তার সাথিরা নিষ্ঠপ্রাণ মুসলিমদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়।
খন্দকযুদ্ধের সময় যখন মক্কার কুরাইশ এবং অন্যান্য আরব গোত্র মদিনা অবরোধ করে ফেলে, তখনো ইবনু উবাই ও তার মুনাফিক সাথিরা মিলে মদিনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম এবং খোদ প্রিয়নবি সা: প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পরিখার পাহারায় ছিলেন। অথচ আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথিরা তখন নিজেদের ঘরে বসে আরামে দিন যাপন করছিল। সেই ক্রান্তিকালে তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে মুসলিমবাহিনীকে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলা, মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে ফেলা, যাতে যুদ্ধের আগেই তাঁরা হেরে যান।
এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জনৈক আনসার ও মুহাজির সাহাবির মধ্যে কিছুটা বাগবিতন্ডা হয়। ইবনু উবাই বিষয়টা জানতে পেরে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে। সে মুহাজির সাহাবিকে খুব জঘন্যভাবে বকাঝকা করে। আনসার সাহাবিদের মুহাজিরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে আরবে বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ শোনায়, ‘ব্যাপারটি তো দেখা যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছে, ‘‘নিজ কুকুরকে মোটা তাজা করো, একদিন সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’’ তোমরা তো এই মুহাজিরদের মাথায় তুলে নিয়েছ, তাই এখন তারা তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে চাচ্ছে।’
এরপর সে উৎসাহী কন্ঠে বলে, ‘আল্লাহর কসম, মদিনায় পৌছেই আমরা সভ্যরা মদিনা থেকে এই অসভ্যদের বিতাড়িত করে ছাড়ব!’
তার একথাটি জায়েদ ইবনু আরকাম নামের অল্পবয়সি এক সাহাবির মাধ্যমে নবিজির কানে যায়। নবিজি তখন ইবনু উবাইকে ডেকে পাঠালে সে তার বাকপটুতার মাধ্যমে মিথ্যা কসম খেয়ে বলে, ‘কসম খোদার, আমি এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। এই অল্পবয়সি ছেলেটি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেনি!’
এরপর মুসলমানরা মদিনায় পৌঁছতেই আল্লাহ তাআলা সুরা মুনাফিক নাজির করে ইবনু উবাইয়ের খোলাসাবৃত চরিত্র প্রকাশ করে দেন। ফলে তাকে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়।
তার সবচেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ ছিল- সে প্রিয়নবি সা: এর প্রিয়তমা স্ত্রী হুমায়রা আয়েশা সিদ্দিকা রা: এর পবিত্র চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের অপপ্রয়াস পেয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নবিজি সা: সহ সম্মানিত সাহাবিরা মানসিকভাবে চূড়ান্ত আঘাত পান। এরপর আল্লাহ তাআলা সুরা নুরের ২ ও ৩ নম্বর আয়াত নাজিল করে সিদ্দিকা আয়েশার পবিত্রতা এবং ইবনু উবাইয়ের ঘৃণ্য অপরাধ প্রকাশ করে দেন। এবারও সে ভীষণ অপমানিত হয়। কারণ, ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে একজন সচ্চরিত্র মহিলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের দায়ে তাকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা হয়; আর পরকালের শাস্তি তো তার পাওনা রয়েছেই।
নিজেদের একের পর এক চক্রান্ত ব্যর্থ হতে দেখে অবশেষে মুনাফিকরা নবিজি সা: কে হত্যার ষড়যন্ত্র হাতে নেয়। তাবুক যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুনাফিক যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গেলেও কতিপয় মুনাফিক নবিজির সঙ্গে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগ পেলেই তারা নবিজিকে হত্যা করে সটকে পড়বে।
তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিমবাহিনী একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে একজন দুজন করে পেরোচ্ছিল। মুনাফিকরা সেখানে ওত পেতে নবিজির অপেক্ষায় বসে থাকে। নবিজির বাহন যখন ওই গিরিপথ মাড়াচ্ছিল, তখন মুনাফিকরা তাদের চেহারার আবরণ পেয়ে আচমকা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ঠিক ওই মুহুর্তে কতিপয় সাহাবি সেখানে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা আক্রমণকারীদের চ্যালেঞ্জ জানাতেই মুনাফিকরা শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
নবিজি সা: তাঁর প্রিয়তম সাহাবি হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা: কে সে সকল মুনাফিকের নাম বলে দিয়েছিলেন, যারা বাহ্যত মুসলিমবেশে মুসলিমদের দলে ঢুকে পড়েছে। এ জন্য হুজায়ফা রা: কে নবিজির রহস্যজ্ঞাত বলা হয়ে থাকে।
নিজ কৃতকর্মের কারণে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়। সকল মুসলমান তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতেন। তবে এতকিছুর পরও সে নিজেকে সংশোধন করতে রাজি ছিল না। সে জানত ইসলামই একমাত্র সত্য দীন; কিন্তু শুরু থেকেই সে এর শক্রতা কিনে নেয়। বাদশাহি হারানোর মর্মজ্বালা সে কখনো ভূলতে পারেনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ইসলামগ্রহণের সৌভাগ্য তা হয়নি। অবশ্য তার কতিপয় সাথি মুনাফিকি বাদ দিয়ে নিষ্ঠ চিত্তে ইসলামগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইবনু উবাই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়। তবে তার ছেলে ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন মুমিন সাহাবি। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নবিজি সা: ইবনু উবাইয়ের অতীতের সকল শক্রুতা ভুলে নিজের জামায় জড়িয়ে তাকে দাফন করেন। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা তাওবার এই আয়াত নাজিল করেন, ‘‘ওদের কারও মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত পড়বেন না’ নাজিল করে ভবিষ্যতে মুনাফিকদের জানাজাসহ কাফিরদের জন্য ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে নিষেধ করে দেন।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুসলিমদের আঁচলে পালিত প্রথম সাপ। সে তাদের ধ্বংস করতে এমনসব ভয়াল চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে রেখেছিল, যদি তখন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মুসলিমদের সঙ্গ না দিত এবং ওহি নাজিলের ধারা অব্যাহত না থাকত, তাহলে তাঁরা পরস্পর লড়াই করে মারা যেতেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামের নাম চিহ্ন মুছে যেত। তবে ইবনু উবাইয়ের সমমনা ইয়াহুদিরা তার মৃত্যুর পরও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। পরবর্তীকালে তারা মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্যা বেড়াঝাল ঢুকিয়ে দে।
ইতিহাস পড়লে অনুমান করা যায়, যুগে যুগে ঘরের শক্রুরা ইসলামের যে ক্ষতি করেছে, প্রকাশ্য শক্ররা তার এক দশমাংশও করতে পারেনি। ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতিসত্তার ওপর বড় বড় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এর মূলে কিন্তু গাদ্দারদেরই ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আপনারা জানেনন, একটি বাগানকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে তুলতে যেমন বাগানে পানি সেচ দিতে হয়, সার ছিটাতে হয়, তেমনি বাগানকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকেও নিরাপদ রাখতে হয়। জাতির গাদ্দাররা এমন বিষাক্ত সাপের মতো, যারা প্রথমে জাতির গা থেকে রক্ত শুষে নেয়, অবশেষে দংশন করে একেবারে মেরে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধর হলো।
মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই
‘মাটি ওড়াবেন না’ রাগে চোখে-মুখ লাল করে বলছিল লোকটি।
প্রিয়নবি সা: এর বাহন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে তখন তার সাথিদের নিয়ে রাস্তার পাশে বসা ছিল। নবিজির ঘোড়ার খুরের আঘাতে ওড়া ধুলোবালি লোকটি ও তার সাথিদের গায়ে গিয়ে লাগলে এভাবে খেপে ওঠে কথাগুলো বলছিল লোকটি; কিন্তু সে তো চিরকালের হতভাগা। সে কি জানত এগুলো কার ঘোড়ার খুরের ধুলো? কী সুমহান মর্যাদা ওই মহামানবের? তাঁর বাহনের ওড়ানো ধুলোর মর্যাদা তো মেশক ও আম্বরের চেয়ে বহুগুণ বেশি। নবিজির সঙ্গে তখন কয়েকজন সাহাবিও ছিলেন। তারা লোকটির এই অশিষ্ট আচরণের জবাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেন। এক সাহাবি তো বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম, নবিজির গাধার গায়ের দুর্গন্ধও তোর গায়ের দুর্গন্ধ থেকে হাজারগুন উত্তম!,
নবিজির সঙ্গে অভদ্র আচরণকারী এই লোকটির নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনু উবাই। সে ছিল মুলত মদিনার ইয়াহুদিদের নেতা। আনসারদের সঙ্গেও তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আনসারদের বড় দুই গোত্র তথা আউস খাজরাজে সে ছিল সমান গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগে আউস ও খাজরাজিরা ছিল একে অপরের প্রাণের শক্রু। বছরের পর বছর পরস্পর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ছিল। একপর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে যায় যে, আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে ইয়াসরিবের (মদিনার) বাদশাহ বানিয়ে নেব, যাতে এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি; ভবিষ্যতে যাতে আমাদের মধ্যে আর লড়াই না বাধে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার মাথায় বাদশাহির মুকুট পরানোর আগেই হজমৌসুম চলে আসে। ফলে মদিনার অনেক মানুষ হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যায়। সেখানে প্রিয়নবি সা: এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। নবিজি সা: তাঁদের ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁরা ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন। হজ শেষে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে স্ব স্ব গ্রোত্র ও মহল্লায় ইসলামের বাণীর প্রচার শুরু করেন। ফলে মদিনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে বাদশাহ বানানোর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কারণ, মদিনাবাসী তো নবিজির মতো দীন-দুনিয়ার অনুপম বাদশাহ পেয়ে গেছে! ফলে আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের মতো কাউকে আর তাদের নেতা মানার প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে ইবুন উবাই- যে এতদিন ধরে মদিনার বাদশাহ হওয়ার রঙিন স্বপ্নজাল বুনে আসছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে অবস্থার মোড় পালটে যেতে দেখে মনে মনে হিংসার আগুনে জ্বলে ভোনা কাবাব হয়ে যাচ্ছিল। সে আনসারদের ইসলামগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এর মধ্যে কিছুদিন পর প্রিয়নবির নির্দেশে একদল সাহাবি মদিনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে আসেন। এরপর তো খোদ নবিজিও আবু বকর রা. কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তখন মদিনার প্রতিটি ঘরে যেন আনন্দের জোয়ার বইছিল। তবে তাঁদের এই আনন্দ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের গায়ে যেন কাঁটা হয়ে বাধছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে তার ক্ষোভ হজম করছিল। কিছুদিন বিভিন্ন বৈঠকে মুসলিমদের নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বলতে থাকে। তবে মানুষ তার এসব কথাকে পাগলের প্রলাপ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে সে নিবিজির নামে বিভিন্ন অপবাদ রটাতে শুরু করে। কিন্তু এবারও হালে পানি না পেয়ে ভাবতে থাকে-নাহ, এভাবে কাজ হবে না; অন্য পথে এগোতে হবে। তখন সে তার শয়তানি মস্তিস্কতাড়িত হয়ে নতুন এক ফন্দি আঁটে।
ইয়াহুদি ধর্মবিশ্বাস ধারণকারী ইবুন উবাই ছিল বেজায় ধূর্ত ও সাংঘাতিক বাকপটু। সে ছিল ধড়িবাজদের উস্তাদ। সে তার কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গকে লক্ষ করে বলে, ‘এভাবে কাজ হবে না। আমাদের বাহ্যত মুহাম্মাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে এবং ভেতরে থেকেই তাদের ধর্মের শিকড় কেটে ফেলতে হবে। আমরা মুসলিমদের অভ্যন্তর থেকে তাদের বিভিন্ন রহস্য কাফিরদের কাছে পাচার করব। তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করব। আমাদের এ কাজটি প্রজন্মান্তর চলতে থাকবে। ,
পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করার পরই ইবুন উবাই তার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে দেয়। তখন তার সঙ্গে কয়েক শ ইয়াহুদিও বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করে। তবে এরা সত্যিকার মুসলমান ছিল না। প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল পাক্কা কাফির। এরা বিভিন্ন সময় মুসলিমদের ভীষণ ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। কুরআন, হাদিস এবং শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের লোকদের ‘মুনাফিক’ বলা হয়। পবিত্র কুরআন মুনাফিকদের পরিণাম প্রসঙ্গে বলেছেন ওরা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম ও সর্বনি¤œ জায়গার অধিবাসী।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুনাফিকদের গুরু। সে প্রথমে উহুদযুদ্ধের সময় মুসলিমদের প্রতি বিষাক্ত ছোবল হানে। উহুদযুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১ হাজার। এর মধ্যে ৩০০ ছিল ইবনু উবাইয়ের সাথি। যুদ্ধে সে তার সাথিদের নিয়ে মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে বেরোলেও কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ এই বলে তার ৩০০ সাথিকে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। ‘আমার পরামর্শ ছিল আমরা মদিনায় থেকে লড়াই করব। যেহেতু আমার পরামর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি, তাই আমি আপনাদের সঙ্গ দিতে পারি না। এ ছাড়া সে মুসলিমদের মধ্যে তখন এই ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায় যে, ‘এটা মূলত কোনো যুদ্ধ নয়; বরং আত্মহত্যার অভিযান। এভাবে সে ও তার সাথিরা নিষ্ঠপ্রাণ মুসলিমদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়।
খন্দকযুদ্ধের সময় যখন মক্কার কুরাইশ এবং অন্যান্য আরব গোত্র মদিনা অবরোধ করে ফেলে, তখনো ইবনু উবাই ও তার মুনাফিক সাথিরা মিলে মদিনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম এবং খোদ প্রিয়নবি সা: প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পরিখার পাহারায় ছিলেন। অথচ আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথিরা তখন নিজেদের ঘরে বসে আরামে দিন যাপন করছিল। সেই ক্রান্তিকালে তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে মুসলিমবাহিনীকে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলা, মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে ফেলা, যাতে যুদ্ধের আগেই তাঁরা হেরে যান।
এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জনৈক আনসার ও মুহাজির সাহাবির মধ্যে কিছুটা বাগবিতন্ডা হয়। ইবনু উবাই বিষয়টা জানতে পেরে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে। সে মুহাজির সাহাবিকে খুব জঘন্যভাবে বকাঝকা করে। আনসার সাহাবিদের মুহাজিরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে আরবে বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ শোনায়, ‘ব্যাপারটি তো দেখা যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছে, ‘‘নিজ কুকুরকে মোটা তাজা করো, একদিন সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’’ তোমরা তো এই মুহাজিরদের মাথায় তুলে নিয়েছ, তাই এখন তারা তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে চাচ্ছে।’
এরপর সে উৎসাহী কন্ঠে বলে, ‘আল্লাহর কসম, মদিনায় পৌছেই আমরা সভ্যরা মদিনা থেকে এই অসভ্যদের বিতাড়িত করে ছাড়ব!’
তার একথাটি জায়েদ ইবনু আরকাম নামের অল্পবয়সি এক সাহাবির মাধ্যমে নবিজির কানে যায়। নবিজি তখন ইবনু উবাইকে ডেকে পাঠালে সে তার বাকপটুতার মাধ্যমে মিথ্যা কসম খেয়ে বলে, ‘কসম খোদার, আমি এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। এই অল্পবয়সি ছেলেটি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেনি!’
এরপর মুসলমানরা মদিনায় পৌঁছতেই আল্লাহ তাআলা সুরা মুনাফিক নাজির করে ইবনু উবাইয়ের খোলাসাবৃত চরিত্র প্রকাশ করে দেন। ফলে তাকে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়।
তার সবচেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ ছিল- সে প্রিয়নবি সা: এর প্রিয়তমা স্ত্রী হুমায়রা আয়েশা সিদ্দিকা রা: এর পবিত্র চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের অপপ্রয়াস পেয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নবিজি সা: সহ সম্মানিত সাহাবিরা মানসিকভাবে চূড়ান্ত আঘাত পান। এরপর আল্লাহ তাআলা সুরা নুরের ২ ও ৩ নম্বর আয়াত নাজিল করে সিদ্দিকা আয়েশার পবিত্রতা এবং ইবনু উবাইয়ের ঘৃণ্য অপরাধ প্রকাশ করে দেন। এবারও সে ভীষণ অপমানিত হয়। কারণ, ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে একজন সচ্চরিত্র মহিলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের দায়ে তাকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা হয়; আর পরকালের শাস্তি তো তার পাওনা রয়েছেই।
নিজেদের একের পর এক চক্রান্ত ব্যর্থ হতে দেখে অবশেষে মুনাফিকরা নবিজি সা: কে হত্যার ষড়যন্ত্র হাতে নেয়। তাবুক যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুনাফিক যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গেলেও কতিপয় মুনাফিক নবিজির সঙ্গে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগ পেলেই তারা নবিজিকে হত্যা করে সটকে পড়বে।
তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিমবাহিনী একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে একজন দুজন করে পেরোচ্ছিল। মুনাফিকরা সেখানে ওত পেতে নবিজির অপেক্ষায় বসে থাকে। নবিজির বাহন যখন ওই গিরিপথ মাড়াচ্ছিল, তখন মুনাফিকরা তাদের চেহারার আবরণ পেয়ে আচমকা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ঠিক ওই মুহুর্তে কতিপয় সাহাবি সেখানে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা আক্রমণকারীদের চ্যালেঞ্জ জানাতেই মুনাফিকরা শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
নবিজি সা: তাঁর প্রিয়তম সাহাবি হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা: কে সে সকল মুনাফিকের নাম বলে দিয়েছিলেন, যারা বাহ্যত মুসলিমবেশে মুসলিমদের দলে ঢুকে পড়েছে। এ জন্য হুজায়ফা রা: কে নবিজির রহস্যজ্ঞাত বলা হয়ে থাকে।
নিজ কৃতকর্মের কারণে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়। সকল মুসলমান তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতেন। তবে এতকিছুর পরও সে নিজেকে সংশোধন করতে রাজি ছিল না। সে জানত ইসলামই একমাত্র সত্য দীন; কিন্তু শুরু থেকেই সে এর শক্রতা কিনে নেয়। বাদশাহি হারানোর মর্মজ্বালা সে কখনো ভূলতে পারেনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ইসলামগ্রহণের সৌভাগ্য তা হয়নি। অবশ্য তার কতিপয় সাথি মুনাফিকি বাদ দিয়ে নিষ্ঠ চিত্তে ইসলামগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইবনু উবাই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়। তবে তার ছেলে ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন মুমিন সাহাবি। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নবিজি সা: ইবনু উবাইয়ের অতীতের সকল শক্রুতা ভুলে নিজের জামায় জড়িয়ে তাকে দাফন করেন। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা তাওবার এই আয়াত নাজিল করেন, ‘‘ওদের কারও মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত পড়বেন না’ নাজিল করে ভবিষ্যতে মুনাফিকদের জানাজাসহ কাফিরদের জন্য ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে নিষেধ করে দেন।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুসলিমদের আঁচলে পালিত প্রথম সাপ। সে তাদের ধ্বংস করতে এমনসব ভয়াল চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে রেখেছিল, যদি তখন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মুসলিমদের সঙ্গ না দিত এবং ওহি নাজিলের ধারা অব্যাহত না থাকত, তাহলে তাঁরা পরস্পর লড়াই করে মারা যেতেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামের নাম চিহ্ন মুছে যেত। তবে ইবনু উবাইয়ের সমমনা ইয়াহুদিরা তার মৃত্যুর পরও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। পরবর্তীকালে তারা মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্যা বেড়াঝাল ঢুকিয়ে দে।

ট্যাগস :

ফেসবুকে আমরা

মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই

আপডেট সময় : ১১:২৭:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জানুয়ারী ২০২৩

ইতিহাস পড়লে অনুমান করা যায়, যুগে যুগে ঘরের শক্রুরা ইসলামের যে ক্ষতি করেছে, প্রকাশ্য শক্ররা তার এক দশমাংশও করতে পারেনি। ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতিসত্তার ওপর বড় বড় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এর মূলে কিন্তু গাদ্দারদেরই ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আপনারা জানেনন, একটি বাগানকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে তুলতে যেমন বাগানে পানি সেচ দিতে হয়, সার ছিটাতে হয়, তেমনি বাগানকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকেও নিরাপদ রাখতে হয়। জাতির গাদ্দাররা এমন বিষাক্ত সাপের মতো, যারা প্রথমে জাতির গা থেকে রক্ত শুষে নেয়, অবশেষে দংশন করে একেবারে মেরে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধর হলো।
মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই
‘মাটি ওড়াবেন না’ রাগে চোখে-মুখ লাল করে বলছিল লোকটি।
প্রিয়নবি সা: এর বাহন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে তখন তার সাথিদের নিয়ে রাস্তার পাশে বসা ছিল। নবিজির ঘোড়ার খুরের আঘাতে ওড়া ধুলোবালি লোকটি ও তার সাথিদের গায়ে গিয়ে লাগলে এভাবে খেপে ওঠে কথাগুলো বলছিল লোকটি; কিন্তু সে তো চিরকালের হতভাগা। সে কি জানত এগুলো কার ঘোড়ার খুরের ধুলো? কী সুমহান মর্যাদা ওই মহামানবের? তাঁর বাহনের ওড়ানো ধুলোর মর্যাদা তো মেশক ও আম্বরের চেয়ে বহুগুণ বেশি। নবিজির সঙ্গে তখন কয়েকজন সাহাবিও ছিলেন। তারা লোকটির এই অশিষ্ট আচরণের জবাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেন। এক সাহাবি তো বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম, নবিজির গাধার গায়ের দুর্গন্ধও তোর গায়ের দুর্গন্ধ থেকে হাজারগুন উত্তম!,
নবিজির সঙ্গে অভদ্র আচরণকারী এই লোকটির নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনু উবাই। সে ছিল মুলত মদিনার ইয়াহুদিদের নেতা। আনসারদের সঙ্গেও তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আনসারদের বড় দুই গোত্র তথা আউস খাজরাজে সে ছিল সমান গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগে আউস ও খাজরাজিরা ছিল একে অপরের প্রাণের শক্রু। বছরের পর বছর পরস্পর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ছিল। একপর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে যায় যে, আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে ইয়াসরিবের (মদিনার) বাদশাহ বানিয়ে নেব, যাতে এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি; ভবিষ্যতে যাতে আমাদের মধ্যে আর লড়াই না বাধে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার মাথায় বাদশাহির মুকুট পরানোর আগেই হজমৌসুম চলে আসে। ফলে মদিনার অনেক মানুষ হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যায়। সেখানে প্রিয়নবি সা: এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। নবিজি সা: তাঁদের ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁরা ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন। হজ শেষে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে স্ব স্ব গ্রোত্র ও মহল্লায় ইসলামের বাণীর প্রচার শুরু করেন। ফলে মদিনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে বাদশাহ বানানোর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কারণ, মদিনাবাসী তো নবিজির মতো দীন-দুনিয়ার অনুপম বাদশাহ পেয়ে গেছে! ফলে আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের মতো কাউকে আর তাদের নেতা মানার প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে ইবুন উবাই- যে এতদিন ধরে মদিনার বাদশাহ হওয়ার রঙিন স্বপ্নজাল বুনে আসছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে অবস্থার মোড় পালটে যেতে দেখে মনে মনে হিংসার আগুনে জ্বলে ভোনা কাবাব হয়ে যাচ্ছিল। সে আনসারদের ইসলামগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এর মধ্যে কিছুদিন পর প্রিয়নবির নির্দেশে একদল সাহাবি মদিনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে আসেন। এরপর তো খোদ নবিজিও আবু বকর রা. কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তখন মদিনার প্রতিটি ঘরে যেন আনন্দের জোয়ার বইছিল। তবে তাঁদের এই আনন্দ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের গায়ে যেন কাঁটা হয়ে বাধছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে তার ক্ষোভ হজম করছিল। কিছুদিন বিভিন্ন বৈঠকে মুসলিমদের নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বলতে থাকে। তবে মানুষ তার এসব কথাকে পাগলের প্রলাপ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে সে নিবিজির নামে বিভিন্ন অপবাদ রটাতে শুরু করে। কিন্তু এবারও হালে পানি না পেয়ে ভাবতে থাকে-নাহ, এভাবে কাজ হবে না; অন্য পথে এগোতে হবে। তখন সে তার শয়তানি মস্তিস্কতাড়িত হয়ে নতুন এক ফন্দি আঁটে।
ইয়াহুদি ধর্মবিশ্বাস ধারণকারী ইবুন উবাই ছিল বেজায় ধূর্ত ও সাংঘাতিক বাকপটু। সে ছিল ধড়িবাজদের উস্তাদ। সে তার কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গকে লক্ষ করে বলে, ‘এভাবে কাজ হবে না। আমাদের বাহ্যত মুহাম্মাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে এবং ভেতরে থেকেই তাদের ধর্মের শিকড় কেটে ফেলতে হবে। আমরা মুসলিমদের অভ্যন্তর থেকে তাদের বিভিন্ন রহস্য কাফিরদের কাছে পাচার করব। তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করব। আমাদের এ কাজটি প্রজন্মান্তর চলতে থাকবে। ,
পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করার পরই ইবুন উবাই তার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে দেয়। তখন তার সঙ্গে কয়েক শ ইয়াহুদিও বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করে। তবে এরা সত্যিকার মুসলমান ছিল না। প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল পাক্কা কাফির। এরা বিভিন্ন সময় মুসলিমদের ভীষণ ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। কুরআন, হাদিস এবং শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের লোকদের ‘মুনাফিক’ বলা হয়। পবিত্র কুরআন মুনাফিকদের পরিণাম প্রসঙ্গে বলেছেন ওরা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম ও সর্বনি¤œ জায়গার অধিবাসী।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুনাফিকদের গুরু। সে প্রথমে উহুদযুদ্ধের সময় মুসলিমদের প্রতি বিষাক্ত ছোবল হানে। উহুদযুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১ হাজার। এর মধ্যে ৩০০ ছিল ইবনু উবাইয়ের সাথি। যুদ্ধে সে তার সাথিদের নিয়ে মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে বেরোলেও কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ এই বলে তার ৩০০ সাথিকে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। ‘আমার পরামর্শ ছিল আমরা মদিনায় থেকে লড়াই করব। যেহেতু আমার পরামর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি, তাই আমি আপনাদের সঙ্গ দিতে পারি না। এ ছাড়া সে মুসলিমদের মধ্যে তখন এই ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায় যে, ‘এটা মূলত কোনো যুদ্ধ নয়; বরং আত্মহত্যার অভিযান। এভাবে সে ও তার সাথিরা নিষ্ঠপ্রাণ মুসলিমদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়।
খন্দকযুদ্ধের সময় যখন মক্কার কুরাইশ এবং অন্যান্য আরব গোত্র মদিনা অবরোধ করে ফেলে, তখনো ইবনু উবাই ও তার মুনাফিক সাথিরা মিলে মদিনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম এবং খোদ প্রিয়নবি সা: প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পরিখার পাহারায় ছিলেন। অথচ আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথিরা তখন নিজেদের ঘরে বসে আরামে দিন যাপন করছিল। সেই ক্রান্তিকালে তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে মুসলিমবাহিনীকে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলা, মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে ফেলা, যাতে যুদ্ধের আগেই তাঁরা হেরে যান।
এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জনৈক আনসার ও মুহাজির সাহাবির মধ্যে কিছুটা বাগবিতন্ডা হয়। ইবনু উবাই বিষয়টা জানতে পেরে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে। সে মুহাজির সাহাবিকে খুব জঘন্যভাবে বকাঝকা করে। আনসার সাহাবিদের মুহাজিরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে আরবে বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ শোনায়, ‘ব্যাপারটি তো দেখা যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছে, ‘‘নিজ কুকুরকে মোটা তাজা করো, একদিন সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’’ তোমরা তো এই মুহাজিরদের মাথায় তুলে নিয়েছ, তাই এখন তারা তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে চাচ্ছে।’
এরপর সে উৎসাহী কন্ঠে বলে, ‘আল্লাহর কসম, মদিনায় পৌছেই আমরা সভ্যরা মদিনা থেকে এই অসভ্যদের বিতাড়িত করে ছাড়ব!’
তার একথাটি জায়েদ ইবনু আরকাম নামের অল্পবয়সি এক সাহাবির মাধ্যমে নবিজির কানে যায়। নবিজি তখন ইবনু উবাইকে ডেকে পাঠালে সে তার বাকপটুতার মাধ্যমে মিথ্যা কসম খেয়ে বলে, ‘কসম খোদার, আমি এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। এই অল্পবয়সি ছেলেটি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেনি!’
এরপর মুসলমানরা মদিনায় পৌঁছতেই আল্লাহ তাআলা সুরা মুনাফিক নাজির করে ইবনু উবাইয়ের খোলাসাবৃত চরিত্র প্রকাশ করে দেন। ফলে তাকে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়।
তার সবচেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ ছিল- সে প্রিয়নবি সা: এর প্রিয়তমা স্ত্রী হুমায়রা আয়েশা সিদ্দিকা রা: এর পবিত্র চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের অপপ্রয়াস পেয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নবিজি সা: সহ সম্মানিত সাহাবিরা মানসিকভাবে চূড়ান্ত আঘাত পান। এরপর আল্লাহ তাআলা সুরা নুরের ২ ও ৩ নম্বর আয়াত নাজিল করে সিদ্দিকা আয়েশার পবিত্রতা এবং ইবনু উবাইয়ের ঘৃণ্য অপরাধ প্রকাশ করে দেন। এবারও সে ভীষণ অপমানিত হয়। কারণ, ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে একজন সচ্চরিত্র মহিলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের দায়ে তাকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা হয়; আর পরকালের শাস্তি তো তার পাওনা রয়েছেই।
নিজেদের একের পর এক চক্রান্ত ব্যর্থ হতে দেখে অবশেষে মুনাফিকরা নবিজি সা: কে হত্যার ষড়যন্ত্র হাতে নেয়। তাবুক যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুনাফিক যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গেলেও কতিপয় মুনাফিক নবিজির সঙ্গে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগ পেলেই তারা নবিজিকে হত্যা করে সটকে পড়বে।
তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিমবাহিনী একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে একজন দুজন করে পেরোচ্ছিল। মুনাফিকরা সেখানে ওত পেতে নবিজির অপেক্ষায় বসে থাকে। নবিজির বাহন যখন ওই গিরিপথ মাড়াচ্ছিল, তখন মুনাফিকরা তাদের চেহারার আবরণ পেয়ে আচমকা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ঠিক ওই মুহুর্তে কতিপয় সাহাবি সেখানে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা আক্রমণকারীদের চ্যালেঞ্জ জানাতেই মুনাফিকরা শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
নবিজি সা: তাঁর প্রিয়তম সাহাবি হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা: কে সে সকল মুনাফিকের নাম বলে দিয়েছিলেন, যারা বাহ্যত মুসলিমবেশে মুসলিমদের দলে ঢুকে পড়েছে। এ জন্য হুজায়ফা রা: কে নবিজির রহস্যজ্ঞাত বলা হয়ে থাকে।
নিজ কৃতকর্মের কারণে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়। সকল মুসলমান তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতেন। তবে এতকিছুর পরও সে নিজেকে সংশোধন করতে রাজি ছিল না। সে জানত ইসলামই একমাত্র সত্য দীন; কিন্তু শুরু থেকেই সে এর শক্রতা কিনে নেয়। বাদশাহি হারানোর মর্মজ্বালা সে কখনো ভূলতে পারেনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ইসলামগ্রহণের সৌভাগ্য তা হয়নি। অবশ্য তার কতিপয় সাথি মুনাফিকি বাদ দিয়ে নিষ্ঠ চিত্তে ইসলামগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইবনু উবাই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়। তবে তার ছেলে ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন মুমিন সাহাবি। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নবিজি সা: ইবনু উবাইয়ের অতীতের সকল শক্রুতা ভুলে নিজের জামায় জড়িয়ে তাকে দাফন করেন। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা তাওবার এই আয়াত নাজিল করেন, ‘‘ওদের কারও মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত পড়বেন না’ নাজিল করে ভবিষ্যতে মুনাফিকদের জানাজাসহ কাফিরদের জন্য ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে নিষেধ করে দেন।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুসলিমদের আঁচলে পালিত প্রথম সাপ। সে তাদের ধ্বংস করতে এমনসব ভয়াল চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে রেখেছিল, যদি তখন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মুসলিমদের সঙ্গ না দিত এবং ওহি নাজিলের ধারা অব্যাহত না থাকত, তাহলে তাঁরা পরস্পর লড়াই করে মারা যেতেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামের নাম চিহ্ন মুছে যেত। তবে ইবনু উবাইয়ের সমমনা ইয়াহুদিরা তার মৃত্যুর পরও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। পরবর্তীকালে তারা মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্যা বেড়াঝাল ঢুকিয়ে দে।
ইতিহাস পড়লে অনুমান করা যায়, যুগে যুগে ঘরের শক্রুরা ইসলামের যে ক্ষতি করেছে, প্রকাশ্য শক্ররা তার এক দশমাংশও করতে পারেনি। ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলিম জাতিসত্তার ওপর বড় বড় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এর মূলে কিন্তু গাদ্দারদেরই ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আপনারা জানেনন, একটি বাগানকে ফলে-ফুলে সুশোভিত করে তুলতে যেমন বাগানে পানি সেচ দিতে হয়, সার ছিটাতে হয়, তেমনি বাগানকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকেও নিরাপদ রাখতে হয়। জাতির গাদ্দাররা এমন বিষাক্ত সাপের মতো, যারা প্রথমে জাতির গা থেকে রক্ত শুষে নেয়, অবশেষে দংশন করে একেবারে মেরে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধর হলো।
মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই
‘মাটি ওড়াবেন না’ রাগে চোখে-মুখ লাল করে বলছিল লোকটি।
প্রিয়নবি সা: এর বাহন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে তখন তার সাথিদের নিয়ে রাস্তার পাশে বসা ছিল। নবিজির ঘোড়ার খুরের আঘাতে ওড়া ধুলোবালি লোকটি ও তার সাথিদের গায়ে গিয়ে লাগলে এভাবে খেপে ওঠে কথাগুলো বলছিল লোকটি; কিন্তু সে তো চিরকালের হতভাগা। সে কি জানত এগুলো কার ঘোড়ার খুরের ধুলো? কী সুমহান মর্যাদা ওই মহামানবের? তাঁর বাহনের ওড়ানো ধুলোর মর্যাদা তো মেশক ও আম্বরের চেয়ে বহুগুণ বেশি। নবিজির সঙ্গে তখন কয়েকজন সাহাবিও ছিলেন। তারা লোকটির এই অশিষ্ট আচরণের জবাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেন। এক সাহাবি তো বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম, নবিজির গাধার গায়ের দুর্গন্ধও তোর গায়ের দুর্গন্ধ থেকে হাজারগুন উত্তম!,
নবিজির সঙ্গে অভদ্র আচরণকারী এই লোকটির নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনু উবাই। সে ছিল মুলত মদিনার ইয়াহুদিদের নেতা। আনসারদের সঙ্গেও তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আনসারদের বড় দুই গোত্র তথা আউস খাজরাজে সে ছিল সমান গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইসলামগ্রহণের আগে আউস ও খাজরাজিরা ছিল একে অপরের প্রাণের শক্রু। বছরের পর বছর পরস্পর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত ছিল। একপর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে যায় যে, আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে ইয়াসরিবের (মদিনার) বাদশাহ বানিয়ে নেব, যাতে এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি; ভবিষ্যতে যাতে আমাদের মধ্যে আর লড়াই না বাধে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার মাথায় বাদশাহির মুকুট পরানোর আগেই হজমৌসুম চলে আসে। ফলে মদিনার অনেক মানুষ হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যায়। সেখানে প্রিয়নবি সা: এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। নবিজি সা: তাঁদের ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁরা ইসলামের ছায়াতলে চলে আসেন। হজ শেষে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে স্ব স্ব গ্রোত্র ও মহল্লায় ইসলামের বাণীর প্রচার শুরু করেন। ফলে মদিনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আবদুল্লাহ ইবনু উবাইকে বাদশাহ বানানোর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কারণ, মদিনাবাসী তো নবিজির মতো দীন-দুনিয়ার অনুপম বাদশাহ পেয়ে গেছে! ফলে আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের মতো কাউকে আর তাদের নেতা মানার প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে ইবুন উবাই- যে এতদিন ধরে মদিনার বাদশাহ হওয়ার রঙিন স্বপ্নজাল বুনে আসছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে অবস্থার মোড় পালটে যেতে দেখে মনে মনে হিংসার আগুনে জ্বলে ভোনা কাবাব হয়ে যাচ্ছিল। সে আনসারদের ইসলামগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এর মধ্যে কিছুদিন পর প্রিয়নবির নির্দেশে একদল সাহাবি মদিনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে আসেন। এরপর তো খোদ নবিজিও আবু বকর রা. কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তখন মদিনার প্রতিটি ঘরে যেন আনন্দের জোয়ার বইছিল। তবে তাঁদের এই আনন্দ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের গায়ে যেন কাঁটা হয়ে বাধছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে তার ক্ষোভ হজম করছিল। কিছুদিন বিভিন্ন বৈঠকে মুসলিমদের নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বলতে থাকে। তবে মানুষ তার এসব কথাকে পাগলের প্রলাপ মনে করে এড়িয়ে যায়। ফলে সে নিবিজির নামে বিভিন্ন অপবাদ রটাতে শুরু করে। কিন্তু এবারও হালে পানি না পেয়ে ভাবতে থাকে-নাহ, এভাবে কাজ হবে না; অন্য পথে এগোতে হবে। তখন সে তার শয়তানি মস্তিস্কতাড়িত হয়ে নতুন এক ফন্দি আঁটে।
ইয়াহুদি ধর্মবিশ্বাস ধারণকারী ইবুন উবাই ছিল বেজায় ধূর্ত ও সাংঘাতিক বাকপটু। সে ছিল ধড়িবাজদের উস্তাদ। সে তার কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গকে লক্ষ করে বলে, ‘এভাবে কাজ হবে না। আমাদের বাহ্যত মুহাম্মাদের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে এবং ভেতরে থেকেই তাদের ধর্মের শিকড় কেটে ফেলতে হবে। আমরা মুসলিমদের অভ্যন্তর থেকে তাদের বিভিন্ন রহস্য কাফিরদের কাছে পাচার করব। তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করব। আমাদের এ কাজটি প্রজন্মান্তর চলতে থাকবে। ,
পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করার পরই ইবুন উবাই তার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে দেয়। তখন তার সঙ্গে কয়েক শ ইয়াহুদিও বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করে। তবে এরা সত্যিকার মুসলমান ছিল না। প্রকাশ্যে মুসলমান হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল পাক্কা কাফির। এরা বিভিন্ন সময় মুসলিমদের ভীষণ ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। কুরআন, হাদিস এবং শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের লোকদের ‘মুনাফিক’ বলা হয়। পবিত্র কুরআন মুনাফিকদের পরিণাম প্রসঙ্গে বলেছেন ওরা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম ও সর্বনি¤œ জায়গার অধিবাসী।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুনাফিকদের গুরু। সে প্রথমে উহুদযুদ্ধের সময় মুসলিমদের প্রতি বিষাক্ত ছোবল হানে। উহুদযুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১ হাজার। এর মধ্যে ৩০০ ছিল ইবনু উবাইয়ের সাথি। যুদ্ধে সে তার সাথিদের নিয়ে মুসলিমবাহিনীর সঙ্গে বেরোলেও কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ এই বলে তার ৩০০ সাথিকে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। ‘আমার পরামর্শ ছিল আমরা মদিনায় থেকে লড়াই করব। যেহেতু আমার পরামর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি, তাই আমি আপনাদের সঙ্গ দিতে পারি না। এ ছাড়া সে মুসলিমদের মধ্যে তখন এই ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায় যে, ‘এটা মূলত কোনো যুদ্ধ নয়; বরং আত্মহত্যার অভিযান। এভাবে সে ও তার সাথিরা নিষ্ঠপ্রাণ মুসলিমদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়।
খন্দকযুদ্ধের সময় যখন মক্কার কুরাইশ এবং অন্যান্য আরব গোত্র মদিনা অবরোধ করে ফেলে, তখনো ইবনু উবাই ও তার মুনাফিক সাথিরা মিলে মদিনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম এবং খোদ প্রিয়নবি সা: প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পরিখার পাহারায় ছিলেন। অথচ আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথিরা তখন নিজেদের ঘরে বসে আরামে দিন যাপন করছিল। সেই ক্রান্তিকালে তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে মুসলিমবাহিনীকে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলা, মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে ফেলা, যাতে যুদ্ধের আগেই তাঁরা হেরে যান।
এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জনৈক আনসার ও মুহাজির সাহাবির মধ্যে কিছুটা বাগবিতন্ডা হয়। ইবনু উবাই বিষয়টা জানতে পেরে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে। সে মুহাজির সাহাবিকে খুব জঘন্যভাবে বকাঝকা করে। আনসার সাহাবিদের মুহাজিরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে আরবে বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ শোনায়, ‘ব্যাপারটি তো দেখা যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছে, ‘‘নিজ কুকুরকে মোটা তাজা করো, একদিন সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’’ তোমরা তো এই মুহাজিরদের মাথায় তুলে নিয়েছ, তাই এখন তারা তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে চাচ্ছে।’
এরপর সে উৎসাহী কন্ঠে বলে, ‘আল্লাহর কসম, মদিনায় পৌছেই আমরা সভ্যরা মদিনা থেকে এই অসভ্যদের বিতাড়িত করে ছাড়ব!’
তার একথাটি জায়েদ ইবনু আরকাম নামের অল্পবয়সি এক সাহাবির মাধ্যমে নবিজির কানে যায়। নবিজি তখন ইবনু উবাইকে ডেকে পাঠালে সে তার বাকপটুতার মাধ্যমে মিথ্যা কসম খেয়ে বলে, ‘কসম খোদার, আমি এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। এই অল্পবয়সি ছেলেটি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেনি!’
এরপর মুসলমানরা মদিনায় পৌঁছতেই আল্লাহ তাআলা সুরা মুনাফিক নাজির করে ইবনু উবাইয়ের খোলাসাবৃত চরিত্র প্রকাশ করে দেন। ফলে তাকে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়।
তার সবচেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ ছিল- সে প্রিয়নবি সা: এর প্রিয়তমা স্ত্রী হুমায়রা আয়েশা সিদ্দিকা রা: এর পবিত্র চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের অপপ্রয়াস পেয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নবিজি সা: সহ সম্মানিত সাহাবিরা মানসিকভাবে চূড়ান্ত আঘাত পান। এরপর আল্লাহ তাআলা সুরা নুরের ২ ও ৩ নম্বর আয়াত নাজিল করে সিদ্দিকা আয়েশার পবিত্রতা এবং ইবনু উবাইয়ের ঘৃণ্য অপরাধ প্রকাশ করে দেন। এবারও সে ভীষণ অপমানিত হয়। কারণ, ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে একজন সচ্চরিত্র মহিলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের দায়ে তাকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা হয়; আর পরকালের শাস্তি তো তার পাওনা রয়েছেই।
নিজেদের একের পর এক চক্রান্ত ব্যর্থ হতে দেখে অবশেষে মুনাফিকরা নবিজি সা: কে হত্যার ষড়যন্ত্র হাতে নেয়। তাবুক যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুনাফিক যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গেলেও কতিপয় মুনাফিক নবিজির সঙ্গে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগ পেলেই তারা নবিজিকে হত্যা করে সটকে পড়বে।
তাবুক থেকে ফেরার পথে মুসলিমবাহিনী একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে একজন দুজন করে পেরোচ্ছিল। মুনাফিকরা সেখানে ওত পেতে নবিজির অপেক্ষায় বসে থাকে। নবিজির বাহন যখন ওই গিরিপথ মাড়াচ্ছিল, তখন মুনাফিকরা তাদের চেহারার আবরণ পেয়ে আচমকা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ঠিক ওই মুহুর্তে কতিপয় সাহাবি সেখানে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা আক্রমণকারীদের চ্যালেঞ্জ জানাতেই মুনাফিকরা শিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
নবিজি সা: তাঁর প্রিয়তম সাহাবি হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা: কে সে সকল মুনাফিকের নাম বলে দিয়েছিলেন, যারা বাহ্যত মুসলিমবেশে মুসলিমদের দলে ঢুকে পড়েছে। এ জন্য হুজায়ফা রা: কে নবিজির রহস্যজ্ঞাত বলা হয়ে থাকে।
নিজ কৃতকর্মের কারণে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়। সকল মুসলমান তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতেন। তবে এতকিছুর পরও সে নিজেকে সংশোধন করতে রাজি ছিল না। সে জানত ইসলামই একমাত্র সত্য দীন; কিন্তু শুরু থেকেই সে এর শক্রতা কিনে নেয়। বাদশাহি হারানোর মর্মজ্বালা সে কখনো ভূলতে পারেনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ইসলামগ্রহণের সৌভাগ্য তা হয়নি। অবশ্য তার কতিপয় সাথি মুনাফিকি বাদ দিয়ে নিষ্ঠ চিত্তে ইসলামগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইবনু উবাই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়। তবে তার ছেলে ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন মুমিন সাহাবি। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নবিজি সা: ইবনু উবাইয়ের অতীতের সকল শক্রুতা ভুলে নিজের জামায় জড়িয়ে তাকে দাফন করেন। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা তাওবার এই আয়াত নাজিল করেন, ‘‘ওদের কারও মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত পড়বেন না’ নাজিল করে ভবিষ্যতে মুনাফিকদের জানাজাসহ কাফিরদের জন্য ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে নিষেধ করে দেন।
আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ছিল মুসলিমদের আঁচলে পালিত প্রথম সাপ। সে তাদের ধ্বংস করতে এমনসব ভয়াল চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে রেখেছিল, যদি তখন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মুসলিমদের সঙ্গ না দিত এবং ওহি নাজিলের ধারা অব্যাহত না থাকত, তাহলে তাঁরা পরস্পর লড়াই করে মারা যেতেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামের নাম চিহ্ন মুছে যেত। তবে ইবনু উবাইয়ের সমমনা ইয়াহুদিরা তার মৃত্যুর পরও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। পরবর্তীকালে তারা মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্যা বেড়াঝাল ঢুকিয়ে দে।